কায়রোর কেন্দ্রস্থলের ঐতিহাসিক এলাকা বাব আল-শারিয়ায় নিজের কবিরাজি দোকানে কবিরাজ রাবি আল-হাবাশি আমাদের যে জিনিস দেখাচ্ছিলেন, সেটিকে তিনি বলেন তার ‘জাদুকরী মিশ্রণ’। কামোদ্দীপক ওষুধ এবং প্রাকৃতিক যৌন শক্তি-বর্ধক বিক্রি করে মিস্টার হাবাশি মিসরের রাজধানীতে বেশ নাম করেছেন।
তবে গত কয়েক বছর ধরে তিনি তার ক্রেতাদের চাহিদায় একটা পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন। তিনি বলছিলেন, এখন বেশিরভাগ পুরুষ নীল বড়ি কিনতে চায়, যেটা তারা পশ্চিমা কোম্পানিগুলো থেকে পায়।
বেশ কিছু গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, তরুণ আরব পুরুষরা এখন আরও বেশি হারে সিলডানাফিল (বাণিজ্যিকভাবে ভায়াগ্রা নামে পরিচিত), ভারডেনাফিল (লেভিট্রা, স্ট্যাক্সিন) এবং টাডালাফিলের (সিয়ালিস) মতো ওষুধ ব্যবহার করছেন।
কিন্তু গবেষণায় এরকম প্রমাণ মেলার পরও মিসর এবং বাহরাইনের রাস্তায় বিবিসি যত তরুণের সঙ্গে কথা বলেছে, তাদের বেশিরভাগই যৌন সমস্যার কারণে এরকম ওষুধ নেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন। অনেকে বলেছেন তারা এই ওষুধের নামও শোনেননি।
এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। কেউ কেউ তো প্রথমে এটা নিয়ে কথাই বলতে চাননি। কারণ, তাদের মতে এটি সমাজের নীতি-নৈতিকতার বিরুদ্ধে।
এই গবেষণা রিপোর্ট নিয়ে খবর বেরিয়েছিল সৌদি সংবাদপত্র আল-রিয়াদে। এতে বলা হয়েছিল, সৌদিরা তখন যৌন শক্তি বর্ধক ওষুধের পেছনে বছরে খরচ করত দেড়শো কোটি ডলার। সৌদি আরবে তখন এরকম ওষুধের ব্যবহার ছিল রাশিয়ার তুলনায় দশগুণ বেশি। অথচ রাশিয়ার জনসংখ্যা সৌদি আরবের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি।
অতি সম্প্রতি ‘আরব জার্নাল অব ইউরোলজি’র এক গবেষণার ফলে দেখা যাচ্ছে, ৪০ শতাংশ উত্তরদাতা তরুণ সৌদি পুরুষ তাদের জীবনে কোনো না কোনো সময়ে ভায়াগ্রার মতো ওষুধ ব্যবহার করেছে।
মিসরের অবস্থান এখনো বেশ উপরের দিকেই। ২০২১ সালের সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সেখানে বছরে পুরুষত্বহীনতার ওষুধ বিক্রি হয় ১২ কোটি ৭০ লাখ ডলারের। এটি মিসরের পুরো ওষুধের বাজারের ২ দশমিক ৮ শতাংশ।
মিসরের মুদি দোকানগুলোতে ২০১৪ সালে ‘আল-ফানকুশ’ নামের একটি যৌন-শক্তি বর্ধক ওষুধ চকোলেট বার হিসেবে বিক্রি হচ্ছিল। আল-ফানকুশের দাম ছিল এক মিসরীয় পাউন্ড (পাঁচ সেন্ট)। তবে বাজারে আসার কিছুদিনের মধ্যেই আল-ফানকুশের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেল। স্থানীয় গণমাধ্যমে বেরিয়েছিল যে আল-ফানকুশ শিশুদের কাছেও বিক্রি করা হচ্ছিল। এরপর নিরাপত্তা বাহিনী এই কোম্পানির মালিককে গ্রেপ্তার করে।
পুরুষত্বহীনতার ওষুধ তরুণদের চেয়ে বয়স্ক পুরুষদের কাছেই বেশি বিক্রি হয়। তবে ইয়েমেনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, সেখানে এ ধরনের ওষুধ মূলত ব্যবহার করে ২৫ হতে ৪৫ বছর বয়সীরা।
ইয়েমেনে ২০১৫ সালে যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। তারপর থেকে সেখানে আনন্দ-ফুর্তি করার পার্টিতে তরুণ পুরুষরা ওষুধ হিসেবে ভায়াগ্রা এবং সিয়ালিসের ব্যবহার শুরু করে বলে স্থানীয় গণমাধ্যমের খবর থেকে ধারণা পাওয়া যায়। ইয়েমেনের এই গৃহযুদ্ধ চলছে হুথি বিদ্রোহী এবং সৌদি সমর্থিত সরকারের মধ্যে।
তিউনিসিয়ার মোহাম্মদ সফাক্সি ইউরোলজি এবং রিপ্রোডাক্টিভ সার্জারি প্রফেসর। তিনি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এই ওষুধগুলোকে ‘উদ্দীপক’ হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ নেই, কারণ এগুলো মূলত বয়স্কদের মধ্যে যে ধরনের সমস্যা দেখা যায়, তার চিকিৎসার জন্য।
এদিকে মধ্যপ্রাচ্যের যৌনবিষয়ক এক বিশেষজ্ঞের মতে, তরুণ আরবরা যে এরকম পুরুষত্বহীনতার ওষুধ ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে, তার মূলে আছে সেখানকার বিদ্যমান সংস্কৃতি।
আরব বিশ্বের যৌন সংস্কৃতির পরিবর্তন নিয়ে একটি বই লিখেছেন মিসরীয়-ব্রিটিশ সাংবাদিক শিরিন আল ফেকি। বইটির নাম- ‘সেক্স এন্ড দ্য সিটাডেল : ইন্টিমেট লাইফ ইন এ চেঞ্জিং আরব ওয়ার্ল্ড। বইটিতে তিনি আরব পুরুষদের যৌন সমস্যার মূলে কী রয়েছে তা খোঁজার চেষ্টা করেছেন।
বইতে, ২০১৭ সালে জাতিসংঘের সহায়তায় মধ্যপ্রাচ্যে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য নিয়ে যে বড় সমীক্ষা হয়েছিল, সেটির উল্লেখ করে তিনি বলছিলেন, সেখানে দেখা গেছে প্রায় সব পুরুষই তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন, কীভাবে তারা তাদের পরিবারের ভরণ-পোষণ জোগাবে সেটা নিয়ে চিন্তিত। এই জরিপে অনেক পুরুষই বলেছিল, একজন পুরুষ হিসেবে তাদের ওপর কী প্রচণ্ড চাপ।
অন্যদিকে নারীদের মন্তব্য ছিল, ‘পুরুষরা আর আগের মতো পুরুষ নেই।’
শিরিন আল ফেকি বলেন, পুরুষ বলতে কী বোঝায় সেটা যেহেতু এখন চাপের মুখে আছে এবং এখানকার পুরুষত্বের সংস্কৃতিতে যেহেতু যৌন ক্ষমতার বিষয়টি এত দৃঢ়ভাবে প্রোথিত, তাই যৌনতায় কে কত পারদর্শী, সেটার ওপর এখন আরও বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে।
মিজ আল ফেকি এজন্যে অবশ্য পর্নোগ্রাফিকেও দায়ী করছেন। তার মতে, এসব দেখে যৌন-ক্রিয়া সম্পর্কে যেসব ভুল ধারণা এবং প্রত্যাশা তৈরি হচ্ছে, সেটার কারণেই এখন পুরুষদের যৌন সক্ষমতার ওপর অনেক বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, পুরুষত্ব বলতে আসলে কি বোঝায়, কোনটা আসলে স্বাভাবিক- এসব পর্নোগ্রাফি তরুণদের মধ্যে সেই ধারণাটাই পাল্টে দিচ্ছে।
আরব সমাজে যৌনতা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা একেবারেই হয় না। যৌন চাহিদার জন্য ওষুধের ব্যবহার আরব সমাজে একটি সাম্প্রতিক ব্যাপার বলে মনে হতে পারে। কিন্তু আসলে আরব ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, যৌন বল-বর্ধক ওষুধের ব্যবহার এখানকার জন সংস্কৃতিরই অংশ ছিল।
ইবনে কাইয়িম আল-জাজিয়া ছিলেন চতুর্দশ শতকের এক গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক গবেষক এবং লেখক। তিনি তার কয়েক খণ্ডের বই ‘অনন্ত জীবনের পাথেয়’ বইতে যৌন কামনা বাড়ানোর ভেষজ ওষুধ কীভাবে তৈরি করতে হবে তার বিস্তারিত প্রস্তুত প্রণালি অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
শিরিন আল ফেকি বলেন, আরব এবং ইসলামি ঐতিহ্যে মনে করা হয়, পুরুষের চাইতে নারীর যৌন তাড়না অনেক বেশি, অনেক বেশি শক্তিশালী। অন্যদিকে পুরুষরা মনে করে এর সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য তাদের যৌন পারদর্শিতা বাড়ানো দরকার।
অটোমান সাম্রাজ্যে এই ধারণার বেশ প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতান প্রথম সেলিমের শাসনকাল ছিল ১৫১২ থেকে ১৫২০ সাল পর্যন্ত। তার অনুরোধে লেখক আহমেদ বিন সুলেইমান একটি বই লেখেন, যেটির নাম ‘শেখ’স রিটার্ন টু ইয়ুথ’, অর্থাৎ ‘শেখের তারুণ্যে প্রত্যাবর্তন।’ এটি আসলে যৌন রোগের চিকিৎসা এবং নারী-পুরুষের যৌন কামনা বাড়ানোর জন্য নানা ধরনের ভেষজ ওষুধ প্রস্তুত প্রণালির এক এনসাইক্লোপিডিয়া।
শত শত বছর পর অনেক আরব তরুণ এখনো এরকম ওষুধই খুঁজছে এবং আরব দেশগুলোতে এই ওষুধের বাজারও বেশ রমরমা।
সূত্র : বিবিসি
মন্তব্য করুন