বিদায়ী অর্থবছর জুড়ে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগে ভাটার টান দেখা গেলেও চলতি অর্থবছরের শুরুতে এ চিত্র পাল্টে গেছে। এ সময় সঞ্চয়পত্র বিক্রির সঙ্গে বেড়েছে নিট বিনিয়োগের পরিমাণও।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ২ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা এসেছে। আগের বছরের একই সময়ে যেখানে নিট বিক্রি ছিল ৩ হাজার ২৪৯ কোটি সেই হিসাবে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এবার নিট বিক্রি কিছুটা কমেছে। তবে পুরো অর্থবছরের সামগ্রিক হিসাবে এটা অনেকাংশে বেড়েছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত অর্থবছরের প্রথম মাসে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ কিছুটা বাড়ে। পরে ধীরে ধীরে তা কমতে থাকে। এ ছাড়া বর্তমানে ব্যাংক খাতে চলছে টালমাটাল পরিস্থিতি। সেইসঙ্গে অনেক ব্যাংক গ্রাহকের টাকা সঠিক সময়ে ফেরত না দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। ফলে ব্যাংকের সুদহার বাড়ানোর পরও অনেকে সঞ্চয়পত্রকেই নিরাপদ মনে করছেন। তাই সঞ্চয়কারীরা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন। পাশাপাশি আগের কেনা সঞ্চয়পত্রে মেয়াদ শেষে আবারও নতুন করে বিনিয়োগ করছেন। এ বিষয়ে জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এবিএম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, বর্তমানে ব্যাংক খাতে এক ধরনের অস্থিরতা চলছে। যার ফলে গ্রাহকের আস্থাহীনতাও বাড়ছে। ফলে তারা সঞ্চয়পত্রে বেশি বিনিয়োগ করছেন। সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ বাড়লে সরকারের সুদ পরিশোধের চাপ বাড়ে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। নিয়ম অনুযায়ী, আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা থাকে। সরকার তা বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। এ কারণে অর্থনীতির ভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রথম মাস জুলাইয়ে সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগ হয়েছে ২ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্রের এই নিট বিনিয়োগই চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১৮ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে নিট বিনিয়োগ হয়েছে ঋণাত্মক ২১ হাজার ১২৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ পুরো অর্থবছরে এ খাত থেকে সরকার এক টাকারও ঋণ নেয়নি। এ বিষয়টিকে মাথায় রেখেই ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা আরও কমানো হয়েছে। এর আগে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। যদিও অর্থবছর শেষে নিট বিক্রি হয়েছিল ঋণাত্মক প্রায় ৩ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অতি মাত্রায় সুদ পরিশোধ কমাতে গত দুই অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে নানা শর্ত দেওয়া হয়। ফলে এ খাতে বিনিয়োগ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিতে নেমেছে। এমন পরিস্থিতিতে চলতি বাজেটে ঘাটতি পূরণে সঞ্চয়পত্রের নির্ভরতাও কমিয়ে ফেলেছে সরকার। কিন্তু চলতি অর্থবছরের শুরুতেই দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। প্রথম মাসেই বেড়েছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি সঙ্গে নিট বিনিয়োগ। গত পাঁচ অর্থবছরে তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ৪৬ হাজার ৫৩০ কোটি টাকার ঋণ নেয় সরকার। পরের অর্থবছর (২০১৮-১৯) নিট ঋণের পরিমাণ বেড়ে ৪৯ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা হয়। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ঋণ নেয় ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছর নেওয়া হয় ৪১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ১৯ হাজার ৯১৬ কোটি টাকার ঋণ নেয় সরকার। এখন ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ থাকলে রিটার্নের সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ ছাড়া গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবরকম সঞ্চয়পত্রের সুদ হার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার। তার আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ সীমা কমিয়ে আনা হয়। এ ছাড়া ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। দুর্নীতি বা কালো টাকায় সঞ্চয়পত্র কেনা বন্ধে ক্রেতার তথ্যের একটি ডাটাবেজ তৈরি হয়েছে। মূলত এসব কারণেই সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ অনেকাংশে কমে গেছে। এদিকে, বর্তমান সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ দায়িত্ব নেওয়ার আগে সবসময়ই সঞ্চয়পত্রকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থার জায়গা হিসেবে বিবেচনা করে এই খাত থেকে সরকারের ঋণ কমানোর সমালোচনা করে আসছেন। অন্যদিকে বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের মতে, সঞ্চয়পেত্র থেকে বেশি ঋণ নিলে সুদ পরিশোধের দায়ও বেশি হয়। তাই সঞ্চয়কত্র থেকে বেশি ঋণ না নেওয়ার পক্ষেই মতামত দেন তিনি। এখন আগামী দিনে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার কতটুকু ঋণ নেবে, সেটাই দেখার বিষয়। এদিকে সম্প্রতি গ্রাহকের ভোগান্তি কমাতে সঞ্চয়পত্রের বিষয়ে নতুন এক নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে বলা হয়েছে, সঞ্চয়পত্রের মেয়াদপূর্তির দিনেই গ্রাহককে আসলসহ মুনাফার টাকা ফেরত দিতে হবে। জানা গেছে, এতদিন সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর আসল টাকা তুলতে সময়ক্ষেপণসহ নানান ভোগান্তির শিকার হতেন গ্রাহক। নতুন এ নির্দেশনার ফলে এ ভোগান্তি দূর হলো। বর্তমানে চার ধরনের সঞ্চয়পত্র রয়েছে। পাঁচ বছরমেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১ দশমিক ৫২, পাঁচ বছরমেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ৭৬, পাঁচ বছরমেয়াদি মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ২৮, তিন বছরমেয়াদি ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। কয়েক দফায় সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো হলেও এখনো তা ব্যাংকের তুলনায় বেশি।
মন্তব্য করুন