জয়পুরহাটের যেকোনো সভা-সমাবেশে বক্তব্য দিতে উঠলে আবু সাঈদ আল মাহমুদ বলতেন, তিনি খাদেম হয়ে মানুষের সেবা করতে এসেছেন। তবে গত ১৫ বছরে টানা তিনবারের সাবেক এই সংসদ সদস্য জয়পুরহাটের অঘোষিত ‘পীর’ হয়ে উঠেছিলেন। নিজের অনুসারীদের নিয়ে গড়ে তোলা চক্রের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতেন পুরো জেলা। বিপক্ষে কেউ কথা বললেই নানা হয়রানি করা হতো বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
দলের নেতা-কর্মী ও জেলার বাসিন্দারা বলছেন, কেন্দ্রীয় নেতা হয়ে আওয়ামী লীগ সরকারে পুরোটা সময় যেন ‘আলাদিনের চেরাগ’ পেয়েছিলেন আবু সাঈদ আল মাহমুদ (স্বপন)। যার মাধ্যমে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। তাঁর স্ত্রী মেহেবুবা আলমও শূন্য থেকে কোটিপতি হয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২ সেপ্টেম্বর আবু সাঈদ আল মাহমুদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত। তবে এ মুহূর্তে আবু সাঈদ আল মাহমুদ দেশে আছেন, নাকি পালিয়ে গেছেন ভারতে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
জেলা গোয়েন্দা পুলিশ জানিয়েছে, আবু সাঈদ আল মাহমুদের বিরুদ্ধে জেলায় একাধিক মামলা হয়েছে। ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি আত্মগোপনে আছেন। এ সময় তিনি ঘনিষ্ঠ অনেকের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেছেন। পুলিশ তাঁকে খুঁজছে।
দলের নেতা-কর্মীরা বলছেন, একসময় তাঁর ব্যবসা ছিল দুগ্ধ খামার, পশুপালন, সবজি ও মাছ চাষ। পরে তাঁর ব্যবসার ধরন—বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিপণন; বেসরকারি সরবরাহ; নির্মাণ ও কমিশন এজেন্ট। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা পরিচালক হিসেবে তাঁর ব্যাংকঋণ সাড়ে সাত শ কোটি টাকার বেশি।
দলের নেতা-কর্মীরা বলেন, আবু সাঈদ আল মাহমুদের জন্মভিটা পাঁচবিবি উপজেলায়। বাবা ছিলেন টেলিফোন এক্সচেঞ্জের কর্মচারী। একসময় নওগাঁয় কর্মরত ছিলেন। আবু সাঈদ নওগাঁ সরকারি কলেজে ভর্তির পর ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। এইচএসসির পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পরে কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক ও সহসভাপতি হন। কালাই-ক্ষেতলাল-আক্কেলপুর নিয়ে গঠিত জয়পুরহাট-২ আসনে ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়ে বিএনপির প্রার্থী গোলাম মোস্তফার কাছে পরাজিত হন। নির্বাচনের কয়েক মাসের মাথায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হন। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রথম সংসদ সদস্য (এমপি) হন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য হয়ে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় জাতীয় সংসদের হুইপ হন। ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর দ্বিতীয়বারের মতো হুইপের পদ পান।
কেন্দ্রীয় নেতা হওয়ায় জয়পুরহাট জেলা আওয়ামী লীগে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন আবু সাঈদ। তাঁর অনুসারী নেতা-কর্মীরা দলে গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি পেতেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও তাঁরা পেতেন দলের সমর্থন। আর তাঁর বিপক্ষে কথা বললে নানা নির্যাতন নেমে আসত। একসময় আল মাহমুদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাহফুজ চৌধুরী ওরফে অবসর চৌধুরী। একপর্যায়ে বনিবনা না হওয়ায় দূরে সরে যান গোলাম মাহফুজ। এরপর মাহফুজ ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকে মামলা হয়। কারাগারেও ছিলেন। এসব মামলার পেছনে আল মাহমুদের প্রত্যক্ষ মদদ ছিল বলে অভিযোগ করেছেন গোলাম মাহফুজ।
জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কালাই উপজেলার মাত্রাই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আ ন ম শওকত হাবিব তালুকদার বলেন, ‘শুধু সাবেক হুইপের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে আমার নামে ১৩টি মামলা দেওয়া হয়। যেসব নেতা সাবেক হুইপকে তোষামোদি করে “জ্বি ভাই”, “হ্যাঁ ভাই” বলতেন, তাঁরাই ভালো পদ পেতেন, ভালো থাকতেন। যেসব নেতা-কর্মী তাঁর বিপক্ষে গেছেন, তাঁরা হামলা আর মামলা উপহার পেয়েছেন।’ তিনি অভিযোগ করেন, আবু সাঈদ এলাকার অনেক টোকাইকে দলীয় ও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পদে বসিয়ে পুনর্বাসন করেছেন। ইউপি সদস্য নির্বাচনে ভরাডুবি হবে, এমন ব্যক্তিকে দলীয় মনোনয়ন পাইয়ে দিয়ে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও ইউপি চেয়ারম্যান বানিয়েছেন।
ক্ষেতলাল উপজেলা আওয়ামী লীগের একজন প্রবীণ নেতা তাইফুল ইসলাম তালুকদার ক্ষেতলাল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় আবু সাঈদকে ক্ষেতলাল খবরদারি করতে দেননি। এ কারণে তাঁরই পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাকিম মণ্ডলকে ২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাইয়ে দিয়েছিলেন।
তাইফুল ইসলাম বলেন, ‘যখন দলের সুসময় ছিল, তখনো আমরা নির্যাতনের শিকার হয়েছি। এখন দলের দুঃসময়ে আমরাই নির্যাতিত হচ্ছি। আবু সাঈদ আল মাহমুদ দলের সুদিনের মধু খেয়ে এখন লাপাত্তা। জয়পুরহাটের আওয়ামী লীগ ধ্বংস করেছেন তিনি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হওয়ায় আবু সাঈদ আল মাহমুদ জয়পুরহাটে তেমন অবস্থান করতেন না। তবে জয়পুরহাটে তাঁর একটি শক্তিশালী চক্র ছিল। চক্রের অন্যতম সদস্য জয়পুরহাট পৌরসভার সাবেক মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান। এ ছাড়া দোগাছি ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলাম, কলেজশিক্ষক মাসুদ রেজা, কালাই উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মিনফুজুর রহমান, ক্ষেতলাল উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তাকিম মণ্ডল, আক্কেলপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোকছেদ আলী মাস্টার, পাঁচবিবি পৌরসভার সাবেক মেয়র হাবিবুর রহমান, আক্কেলপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আহসান কবির, জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক রাসেল দেওয়ান মিলন, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কালীচরণ আগরওয়ালাও এই চক্রের অংশ ছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত সংসদ নির্বাচনের পর আহসান কবির চক্র থেকে বেরিয়ে যান। ৫ আগস্টের পর চক্রের সদস্যরা আত্মগোপনে চলে গেছেন।
দলীয় নেতা-কর্মী ও স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, এই চক্র ১৬ বছর ধরে নির্বাচনী এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরি কাম নৈশপ্রহরী নিয়োগ, মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ–বাণিজ্য করেছে। জেলার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করেছে। আবু সাঈদের পাশাপাশি তাঁর স্ত্রী মেহেবুবা আলমও ঠিকাদারি সিন্ডিকেটের একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
জেলার সবচেয়ে বড় পশুরহাট জয়পুরহাট পৌরসভার নতুনহাট। সপ্তাহের প্রতি শনিবারে সাড়ে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার গরু কেনাবেচা হয়। প্রতিবছর হাটটি ইজারা পেতেন কালীচরণ আগরওয়ালা।
জয়পুরহাটের ঠিকাদার জহুরুল ইসলাম বলেন, সাবেক হুইপের ঠিকাদারি চক্র দেখতেন প্রভাষক মাসুদ রেজা। কয়েক বছর ধরে পানি উন্নয়ন বোর্ড, এলজিইডি, সড়ক ও জনপথ, শিক্ষা প্রকৌশলীর যত বড় বড় কাজ প্রভাষক মাসুদ রেজা, কালীচরণ আগরওয়ালা করেছেন।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, ১২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জেলার চারটি নদ–নদী ছোট যমুনা, তুলসীগঙ্গা, হারাবতি ও চিড়ি পুনঃখনন ও বাঁধ নির্মাণকাজ ২০২২ সালের জুন মাসে শেষ হয়েছে। আবু সাঈদের তদবিরে প্রকল্পগুলো এসেছিল। কাগজে-কলমে ঢাকা, নাটোর, ফেনী, বরগুনা, পটুয়াখালী, রংপুর, খুলনার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে। তবে এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কেউ কাজ করেননি। কলেজশিক্ষক মাসুদ রেজা কাজগুলো বাস্তবায়ন করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জয়পুরহাট পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমরা তো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে বিল দিয়েছি। কাজেই স্থানীয়ভাবে যদি কেউ ঠিকাদারি করে থাকে, তাহলে সেটা আমার বলাটা সঠিক হবে না।’
ক্ষেতলাল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ারুজ্জামান নাদিম বলেন, আবু সাঈদ আওয়ামী লীগকে কোণঠাসা করে রেখেছিলেন। যাঁরা ভাইলীগ করতেন, তাঁরাই ভালো থাকতেন। দলীয় মনোনয়ন–বাণিজ্যে হয়েছে। আবু রাশেদ আলমগীর দলীয় কোনো পদে ছিলেন না। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তাঁকে বড়াইল ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দিয়ে চেয়ারম্যান বানানো হয়েছে। এ রকম অনেক মনোনয়ন–বাণিজ্য করা হয়েছে।
মন্তব্য করুন