দেশে প্রশাসন থেকে সব ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করতে কাজ করে যাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনের মুখে সাবেক চেয়ারম্যান আবু হেনা রহমাতুল মুনিমকে সরিয়ে আব্দুর রহমান খানকে চেয়ারম্যান করা হয়; কিন্তু চেয়ারম্যান পরিবর্তন হলেও এনবিআরের কর্মকর্তাদের বৈষম্যের অবসান হচ্ছে না। ক্ষেত্রবিশেষে বৈষম্য আরও প্রকট হয়েছে। সর্বশেষ শুল্ক ক্যাডারের যুগ্ম কমিশনার থেকে অতিরিক্ত কমিশনার পদে ব্যাচের প্রথম ও দ্বিতীয়সহ ১১ জন কর্মকর্তাকে সুপারসিড করে ২০ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এই তালিকায় বিভিন্ন সময়ে অনিয়মের কারণে তাৎক্ষণিক বদলি (স্ট্যান্ড রিলিজ) করা কর্মকর্তাও রয়েছেন। এর আগে কমিশনার পদেও ক্লিন ইমেজের কর্মকর্তাদের সুপারসিড করে অনিয়মের অভিযোগে অভিযুক্ত কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়েছেন। এর পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন আওয়ামীপন্থি একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। যিনি বিগত সরকারের আমলে সরকারের মন্ত্রী থেকে শুরু করে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাসও দিয়েছেন। এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, যুগ্ম কমিশনার পদ থেকে নতুন করে ২০ জন কর্মকর্তাকে গত মঙ্গলবার অতিরিক্ত কমিশনার হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এই পদোন্নতিতে বাদ পড়েছেন ব্যাচের প্রথম আয়েশা আখতার ও দ্বিতীয় শাহীনুর কবির পাভেল। যদিও আয়েশার স্বামী সাবেক সরকারের পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হওয়ার কারণে বাদ পড়েছেন বলে কালবেলাকে জানিয়েছেন একাধিক শুল্ক কর্মকর্তা। যদিও এর আগে কমিশনার পদে পদচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ডিআইজির ভাই গোপালগঞ্জের বাসিন্দা এ কে এম সোহেল রহমানকে পদোন্নতি দিয়ে কমিশনার করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সুপারসিড করা হয়েছে বুয়েটের সাবেক শিক্ষার্থী বগুড়ার বাসিন্দা মান্নান সর্দারকে। যুগ্ম কমিশনার থেকে অতিরিক্ত কমিশনার পদে আরও বাদ পড়েছেন দেলওয়ার হোসেন, সুমন দাশ, সামসুল আরেফিনসহ অনেক কর্মকর্তা; কিন্তু অতিরিক্ত কমিশনারের এই পদোন্নতির তালিকায় প্রথমেই রয়েছে মো. মশিউর রহমানের নাম। তার বিরুদ্ধে পানগাঁও কাস্টম হাউসে থাকাকালীন হয়রানির অভিযোগও তুলেছেন অনেক ব্যবসায়ী। মশিউরের ভাই আয়কর বিভাগের একজন কমিশনার ছিলেন। এ ছাড়া তার ভাই ও তার পরিবারের সবাই বর্তমানে কানাডায় বসবাস করেন।
এই পদোন্নতি তালিকায় রয়েছেন আগের চেয়ারম্যানের সময় গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পোস্টিং পাওয়া শাকিলা পারভীন। অতিরিক্ত কমিশনার হয়েছেন অনিয়মের অভিযোগে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস দ্রুত বদলি করে দেওয়া কর্মকর্তা মাহবুব হাসান। এছাড়া পদোন্নতির তালিকায় রয়েছেন মোংলা কাস্টম হাউসে চার হাজার সিসির অডি গাড়ি পনেরশ সিসিতে শুল্কায়ন করা কর্মকর্তা মুহাম্মদ মাহফুজ আহমদ। এই পদোন্নতির তালিকায় রয়েছেন শুল্ক ক্যাডারের আলোচিত কর্মকর্তা রাকিবুল হাসান। যাকে বিভিন্ন অভিযোগের কারণে এনবিআরের অ্যাসাইকুডা (অটোমোটেড সিস্টেম ফর কাস্টমস ডাটা) থেকে সরিয়ে বদলি করা হয়। একই শাখার দ্বিতীয় সচিব থেকে প্রথম সচিব হয়ে সাবেক চেয়ারম্যানের আমলে দীর্ঘদিন ছিলেন দাপুটে এই কর্মকর্তা। এ ছাড়া আরও একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও তারা পদোন্নতি পেয়েছেন।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান কালবেলাকে বলেন, বর্তমান সময়ে এই ধরনের কোনো ঘটনা নেই। তবুও বদলি-পদোন্নতিতে এই ধরনের কর্মকাণ্ড ঘটে থাকলে আমরা কাজ করব।
সূত্র আরও জানায়, পদোন্নতিতে এখনও প্রাধান্য পাচ্ছেন পুরোনো সুবিধাভোগীরা। স্বর্ণ চোরাচালান সংক্রান্ত মামলায় চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়া শুল্ক ক্যাডারের ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তা সালাউদ্দিন রিপনকে বৈষম্যের শিকার বলে রাতারাতি সহকারী কমিশনার থেকে উপকমিশনার হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। আর জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে অভূতপূর্ব পদোন্নতি দেওয়ার জন্য প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এর আগে শুল্ক ক্যাডারে কমিশনার পদেও সুপারসিড করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কপাল পুড়েছে বগুড়ার বাসিন্দা সাবেক বুয়েটের শিক্ষার্থী মান্নান সর্দারের। তাকে সুপারসিড করে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে গোপালগঞ্জের বাসিন্দা পুলিশের সাবেক এক ডিআইজির ভাই একেএম সোহেল রহমানকে। এ ছাড়া বিতর্কিত অতিরিক্ত কমিশনার শামীমা আখতারকে কমিশনার পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এনবিআরের আরেক ক্লিন ইমেজের দক্ষ কর্মকর্তা নাজমুল হক সরকারকে সুপারসিড করে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে গোপালগঞ্জের অরুণ কুমার বিশ্বাসকে। এ ছাড়া শামীম আরা ও শফিউদ্দিনকে কমিশনার হিসেবে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর আগে এনবিআরের কর ক্যাডারে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়। সেখানেও ছিল পুরোনো সুবিধাভোগীদের প্রাধান্য। এই পদোন্নতিতে সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাঈদ আহমেদ পলকের ‘কাজিন’ হিসেবে পরিচিত গোলাম কিবরিয়াকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অব্যাহতি সংক্রান্ত বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।
এনবিআরের নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে আব্দুর রহমান খান যোগ দেওয়ার পর শুল্ক ক্যাডারের ১৩ ব্যাচের দুই কর্মকর্তাকে গ্রেড-১ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেন। এস আলমের ঘনিষ্ঠ সহযোগী বলে পরিচিত কর ক্যাডারের আরেক কর্মকর্তা সৈয়দ মোহাম্মদ আবু দাউদকে গ্রেড-১ হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, যিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাদল সৈয়দ হিসেবে পরিচিত। তিনি চট্টগ্রামের কর অঞ্চল-১ এর দায়িত্বে থাকাকালীন এস আলম গ্রুপের সাইফুল আলমের দুই ছেলে অবৈধভাবে ৫০০ কোটি টাকা বৈধ করেন।
মন্তব্য করুন