নাগরিকদের বাক স্বাধীনতা রক্ষা এবং জাতীয় নিরাপত্তার গুরুত্ব তুলে ধরে সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩ এর জরুরি সংশোধনের আহ্বান জানিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞ, আইসিটি প্রতিনিধি ও মিডিয়া পেশাজীবীরা। এই আইনের বিকল্প নেই বলেও মত দিয়েছেন তারা।
এতে অতিথি ছিলেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী এবং বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সাইবার নিরাপত্তা আইনটিতে কিছু বিতর্কিত বিষয় থাকলেও এটি দেশের ডিজিটাল অবকাঠামো রক্ষা, অনলাইন লেনদেনের নিরাপত্তা এবং সাইবার অপরাধ মোকাবিলায় অপরিহার্য। তারা জাতীয় নিরাপত্তা এবং নাগরিক অধিকার সুরক্ষার মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
গোলটেবিল বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন টিআরএনবি সভাপতি সমীর কুমার দে। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন টিআরএনবির সাবেক সভাপতি ও ভিউজ বাংলাদেশের সম্পাদক রাশেদ মেহেদী। স্বাগত বক্তব্য রাখেন টিআরএনবি সাধারণ সম্পাদক মাসুদুজ্জামান রবিন।
সাইবার সুরক্ষা আইন হালনাগাদ করা হচ্ছে জানিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী ‘সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না’ নীতি গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, সুরক্ষার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বড় ইস্যু। আইনের ভাষায় নেতিবাচক কিছু আছে কি না সেটা দেখতে হবে। আইন নিবর্তনমূলক হওয়া যাবে না। সেলফ সেন্সরশিপ মানে এমন নয় যে, যা বলার কথা তা আমরা বলছি না।
সাইবার সুরক্ষায় করণীয় বিষয়ে সচিব বলেন, জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে আমরা বাক-স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছি। একে অর্থবহ করতে আমাদের সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে। আমার দফতর থেকে মাত্র তিন-চার জন ব্যক্তি দিয়ে জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ (এনসিএসএ) চলছে। অথচ এটিকে আরও শক্তিশালী করা দরকার। একইসঙ্গে নাগরিকদের নিয়ে বেশি বেশি নাগরিক সংলাপ করতে চাই। সব পক্ষের মত নিয়েই এই আইন সংশোধন করা হবে।
বিটিআরসি চেয়ারম্যান এমদাদ উল বারী বলেন, ডেটা সুরক্ষা ও তথ্য শেয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা সহজ নয়। এরমধ্যে রয়েছে ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান ভেদের দ্বন্দ্ব। আর সবচেয় বড় চ্যালেঞ্জ বাক-স্বাধীনতায় ভারসাম্য রক্ষা। সংস্কৃতি ও জাতীয়তার সীমার মধ্যে যদি আমরা দূরত্ব কমাতে পারি তাহলে সমাধান সহজ হবে। এই সমাধানটা নিজেদের মতো করে ‘সেলাই’ করতে হবে।
তিনি বলেন, ডিজিটাল অপরাধ শনাক্তের জন্য আইন করতে হবে। কোন প্রযুক্তি আমরা কীভাবে ব্যবহার করবো সেজন্য আগাম চিন্তা করে আগামীতে কোন মূল্যবোধ নিয়ে চলবো, কতটুকু যন্ত্রের ওপর নির্ভর করবো তা নির্ধারণ করতে পারবো। থ্রিজি আনার সময় এক পক্ষ নিরাপত্তা দিতে না পারার কারণে মত দেওয়া হয়েছিলো। আবার ব্যবসায়ীরা প্রবৃদ্ধি করেছিলেন। কোনো যুক্তিই অমূলক নয়। তাই এই দুইয়ের মধ্যে যে ব্যবধান রয়েছে তা বের করতে হবে।
তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সুমন আহেমদ সাবির বলেন, সাইবার স্পেস ভিত্তিক অপরাধের জন্য বিচার করাকে আমি অযৌক্তিক মনে করি। অপরাধকে অপারাধের গুরুত্ব ও প্রভাবের মাত্রা অনুযায়ী বিচার হওয়া দরকার। আসলে নতুন মাধ্যমে অপরাধ প্রমাণের সক্ষমতা আমাদের দরকার। রাষ্ট্রীয়ভাবে তথ্যের নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা আইন করে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো না। ক্রস বর্ডার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আমাদের বৈশ্বিক জোটগুলোর সঙ্গে যুথবদ্ধতা বাড়াতে হবে। নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন পূরণে বাক-স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে প্রযুক্তি উন্নয়নের সঙ্গে আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের প্রযুক্তি বিভাগ আনোয়ার টেকনোলজিসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ওয়ায়েজ আর হোসেন বলেন, ডিজিটাল যুগে সাইবার আইন আরও উন্নত করা অপরিহার্য, কারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিরাপত্তা ঝুঁকির মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ, মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা এবং বিশেষ করে তরুণদের মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি, সফটওয়্যার শিল্প ও স্টার্টআপের বিকাশের জন্য উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করতে মেধাস্বত্বের সুরক্ষা অত্যন্ত জরুরি।
তিনি বলেন, আমরা ডিজিটাল পরিবেশের মধ্য দিয়েই বড় হয়েছি। আইনে তরুণদের সুরক্ষা না থাকলে আমরা ঝুঁকিতে পড়বো। কেননা, সাইবার ক্রাইমের মধ্যে বাক-স্বাধীনতা, অনলাইন হ্যারাজমেন্ট, সাইবার বুলিং ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। তরুণদের পাশাপাশি, নাগরিক ও ব্যবসাকেও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
রবির কোম্পানি সচিব ব্যারিস্টার সাহেদ আলম বলেন, আইনের ছাত্র হিসেবে আমি বুঝি আমাদের দেশে ডিজিটাল ডোমেইন অবকাঠামো বলে কিছু নেই। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৬০টি ধারার মধ্যে ৩৭টি ধারাই ছিল অপরাধ চিহ্নিত করার জন্য। এতে ১৮টি অপরাধ গণ্য করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ বৈশ্বিক সাইবার অপরাধের দিক দিয়ে ভালো অবস্থানে আছে। তবে ই-গভর্ন্যান্সে আমরা পিছিয়ে আছি। তাই আমাদের কিসের জন্য কোন আইন দরকার তা আগে নির্ধারণ করতে হবে। আমার মনে হয়, বিদ্যমান আইনটি সংশোধন করার কিছু নেই। তাই এটি পুরোপুরি বাতিল করে নতুন করে করা উচিত। ডিজিটাল ইকোনমি যুক্ত করে টেলিকম আইনটিও হালনাগাদ বা নতুন করে করা দরকার।
বেসিসের সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির বলেন, বাক-স্বাধীনতায় ভারসাম্য রক্ষায় সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। এজন্য স্কুল থেকেই গঠনমূলক সমালোচনা করার সচেতনতা খুবই প্রয়োজন। এভাবেই সেলফ সেন্সরশিপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর পাশাপাশি ডিজিটাল ফরেনসিক কীভাবে ও কতটুকু পর্যন্ত আদালতে গ্রহণযোগ্য সেদিকে নজর দিতে হবে। আমাদের দেশে ডেটা প্রাইভেসি না থাকায় আমাদের ব্যবসাও হুমকির মুখে পড়বে। তাই সবার আগে সেন্সেভিটির ওপর ভিত্তি করে ডেটা ক্যাটাগারাইজেশন করা দরকার।
মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন এমটব মহাসচিব মোহাম্মদ জুলফিকার বলেন, নতুন আইন করার ক্ষেত্রে অপরাধকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে উপধারাগুলোকে সুনির্দিষ্ট করতে হবে। আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে সংশোধনের সুযোগ রাখতে হবে। অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে এগিয়ে যেতে হবে। অপরাধ শনাক্তকরণে বিচারকদের প্রশিক্ষিত করতে হবে।
বিডি ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কায়সার হামিদ বলেন, দেশের আর্থিক খাত খুবই ঝুঁকি প্রবণ। প্রতিদিন দেশের আর্থিক খাতে ৬৩০টি সাইবার আক্রমণ হয়। তাই সাইবার অপরাধ কীভাবে ঘটে তা নির্ধারণ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো ঠিক করতে হবে। ডেটাসুরক্ষা আইন করতে হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে কার্যকরভাবে সিকিউরিটি অপারেশন সেন্টার তথা ছক বাস্তবায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে একটি ম্যানেজড ছক গড়ে তুলতে হবে। একইসঙ্গে দেশে কোন তথ্য রাখা বাধ্য করতে হবে তা নির্ধারণ করা দরকার।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই নাবিল বি আরিফ বলেন, সাইবার নিরাপত্তার আইনে শাস্তি নয় সুরক্ষাকেই গুরুত্ব দেওয়া দরকার। সাম্প্রতিক সময়ের দুর্ঘটনায় সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনার জন্য যে ধরনের কাণ্ড ঘটেছে তা দুঃখজনক। এটা আইনের কাজ নয়। তাই আমাদের আইনের ভাষা পরিচ্ছন্ন ও বোধগম্য হতে হবে। মানুষের নিরাপত্তাকেই সবার ওপরে গুরুত্ব দিতে হবে যেন তারা ভীত না হন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, অপরাধের ধরন অনুযায়ী অপরাধের ক্ষত তৈরি হয়। এজন্য বিচার বিভাগীয় তদারকি থাকা দরকার। ফেসবুক পোস্ট কন্টেন্ট সংশ্লিষ্ট অপরাধ। এটাই সব নয়। তাই বাকস্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ সাইবার সুরক্ষা আইনে প্রাধান্য পাওয়া উচিত নয়। এজন্য আমাদের ছাত্র-শিক্ষক-ব্যবসায়ী-জনতার অংশগ্রহণে এই আইন করা দরকার। তা না হলে বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।
মন্তব্য করুন